এক পলকে মনে হবে, লাল শাপলার কোনো চাদর। পুরো বিলজুড়ে বিছানো শাপলা। তাই গ্রামটির নামই হয়ে গেছে 'শাপলা বিল'। সবাই এই নামে ডাকে উত্তর সাতলা গ্রামটিকে।বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সাতলা ইউনিয়নের কালবিলা গ্রামে প্রাকৃতিকভাবেই এই শাপলার অবারিত রঙ্গিন রুপ যে কাউকে মুগ্ধ করবে। রুপসী বাংলার এই রুপের প্রশংসা এখন গ্রাম ছাড়িয়ে দেশ-দেশান্তরে।
জকে আমরা আপনাদের নিয়ে যাব এক ফুলের রাজ্যে। যেখানে চারদিকে শাপলা ফুলের সমারোহ। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে শাপলার এক বিশাল রাজ্য। কখনো কখনো চোখ ধাঁধিয়ে যায়! মন জুড়িয়ে যায়। ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকায় চেপে হারিয়ে যাওয়া যায় শাপলা ফুলের এই রাজ্যপাটে।
বরিশাল সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে উজিরপুর উপজেলার অন্তর্গত সাতলা গ্রামে গেলে দেখা মিলবে নয়নাভিরাম এক দৃশ্যের।প্রায় ১০ হাজার একর জলাভূমি জুড়ে এরকম লাল শাপলার আধিক্য। এখানকার অধিকাংশ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয় শাপলা চাষ ও এর বিপণনের মাধ্যমে।
সাতলা বর্তমানে একটি পর্যটকমুখী এলাকা হলেও এটি একটি বিলের নাম। একসময়ে বর্ষাকালে এটা সম্পূর্ণ ডুবে যেত। স্বাধীনতার পরে তৎকালীন মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত প্রথম সাতলায় বাঁধ দেওয়ার কাজ শুরু করেন। তারপর বিল থেকে বিশাল এলাকা উত্থিত হয়ে বর্তমানে মনোরম এলাকায় পরিণত হয়েছে সাতলা গ্রাম। এই বিলে প্রাকৃতিকভাবে শাপলা ফোটে। ছোট নদী, হাওর ও বিলবেষ্টিত ছোট গ্রাম সাতলা।
ইউনিয়নের উত্তর সাতলা গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী আগৈলঝাড়া উপজেলার বাগধা ইউনিয়নের বাগদা ও খাজুরিয়া গ্রামের কয়েকশ হেক্টর জমি নিয়ে এ বিলের মূল অবস্থান। সবচেয়ে বেশি শাপলার উপস্থিতি দেখা যায় সাতলার নয়াকান্দি ও মুড়িবাড়ীতে। এখানে মার্চ/এপ্রিল থেকে শুরু করে নভেম্বর/ডিসেম্বর পর্যন্ত শাপলার দেখা মেলে। সূর্যের তেজ যত তীব্র হয় শাপলা ফুল ততই বুজে যায়। শাপলার আসল সৌন্দর্য উপভোগের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত। তাই শাপলার পরিপূর্ণ সৌন্দর্য দেখতে চাইলে খুব সকালেই সাতলা যাওয়া উত্তম।

বর্ষার শুরুতে শাপলার জন্ম হলেও হেমন্তের শিশির ভেজা রোদমাখা সকালের জলাশয়ে চোখ পড়লে রং-বেরঙের শাপলার বাহারী রূপ দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। মনে হত কোন এক সাজানো ফুল বাগানের মধ্যে শ্রষ্টার শ্রেষ্ট জীব হিসেবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছি। এদৃশ্য চোখে না দেখলে বোঝানো যাবে না। ওইসব লাল শাপলার বিলে ছুঁটে আসতেন প্রকৃতি প্রেমীরা। অনেকে আবার শাপলা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে।
স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য হওয়ায় এলাকার লোকজন শাপলা তুলে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে বিক্রি কম করলেও স্বরুপকাঠির আটঘর, কুড়িয়ানা, ইন্দেরহাট, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজন বর্ষা মৌসুমে বড় বড় নৌকায় করে তাদের এলাকায় বিক্রির জন্য নিয়ে যায়। এ শাপলা শহুরে জীবনেও খাদ্য তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।

বাণিজ্যিকভাবে শাপলার চাষাবাদ না হওয়ায় স্থানীয় কৃষি অফিসে এর কোন পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও ওই কর্মকর্তার দাবি সাতলায় অন্তত ৫০-৬০ হেক্টর জমিতে শাপলা জন্মায়। তবে, স্থানীয় কৃষকরা আরও বেশী বলে জানিয়েছে। অনেকের কাছে শাপলা সৌন্দর্য আর আনন্দের বিষয় হলেও কৃষকের কাছে চরম বিরক্তিকর বলে দাবি করেছেন কৃষক দিনু বিশ্বাস, শ্যামল মন্ডল, জুরান বিশ্বাসসহ অনেকেই। তারা বলেন, বোরো মৌসুমের আগে জমিতে চাষাবাদের জন্য এই শাপলার কারণে জমি পরিস্কার করতে তাদের গুনতে হয় সাধারণের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ। ভাল চাষ না করতে পারলে জমিতে ফলনও কম পাওয়া যায়।
প্রতিদিন বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ভ্রমণ পিপাসুরা স্ব-পরিবারে ছুটে আসছেন প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্য শাপলার বিলের নয়নাভিরাম দৃশ্য স্বচক্ষে দেখার জন্য। শাপলার বিল ঘুরে দেখতে পর্যটকদের জন্য এখানে রয়েছে নৌকা ও ইঞ্জিনচালিত ট্রলারের সু-ব্যবস্থা।
স্থানীয় চার উদ্যোক্তা পর্যটকদের জন্য বিলের মধ্যে খাওয়ার ও থাকার সু-ব্যবস্থা করেছেন। দেশ-বিদেশীদের কাছে শাপলার বিলের ঐতিহ্য তুলে ধরার জন্য বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন।
সাতলা গ্রামের আকর্ষণ ও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বিশেষখ্যাতি রয়েছে লাল শাপলার। গত কয়েক বছর থেকে ভ্রমনপিপাসুরা সাতলা গ্রামকে লাল শাপলার স্বর্গরাজ্য হিসেবে অভিহিত করেছেন। তবে সাতলা নামের সাথে শাপলার কোনো সম্পর্ক রয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই স্থানীয়দের কাছে। বিলে ঠিক কতো বছর আগে থেকে এভাবে শাপলা জন্মাতে শুরু করেছে তারও কোনো সঠিক তথ্য দিতে পারেননি কেউ। এই বিলে শুধু শাপলাই ফোটে না, শীতের মৌসুমে যখন পানি কমে যায়, তখন এখানে কৃষকরা ধান চাষ করেন। সাধারণত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে এই বিলে লাল শাপলা ফুল ফোটে।